বৃক্ষরোপণ বাংলা রচনা

বৃক্ষরোপণ 

ভূমিকা:
“বৃক্ষ নেই, প্রাণের অস্তিত্ব নেই, বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।”
অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। এই পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃরাজি। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আবার মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম। 
“দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”
-কবির এ আর্তি আজ অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। কেননা অরণ্য দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের কুঠারের আঘাতে। এ হচ্ছে মানুষের আত্মঘাতি কর্ম।

বাংলাদেশের বনাঞ্চল: প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্রের এ দেশে বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র রূপে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:

১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি
২. শালবন বনভূমি ও
৩. স্রোতজ বনভূমি
চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাসমূহ ও সিলেট অঞ্চলে পনের হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি। ভাওয়াল ও মধুপুরের এক হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লার বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে শালবন। আর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাজমান সুন্দরবন-ই হচ্ছে স্রোতজ বনভূমি।

বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ: একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশে মোট ভূমির মাত্র ১৬ ভাগ বনভূমি রয়েছে যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে এটি সরকারি হিসেবে, প্রকৃত-প্রস্তাবে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯%, আর World Research Institute এর মতে মাত্র ৫%। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। তাই ইতমধ্যেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশে সময়মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না এবং অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নেত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া।

বনায়ন বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা: World Research Institute এর মতে, বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। মানুষ ও প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ব্যাপক আবশ্যকতা রয়েছে। তাই বৃক্ষকে মানবজীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু, সে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কত যে উপকার করছে তা একবার ভেবে দেখলে অনুধাবন করা যায়। প্রত্যক্ষ বা পরোভাবে বৃক্ষই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিচে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হল:
  • বৃক্ষ প্রাণীজগৎকে খাদ্য দেয়। মানুষ ও পশু-পাখি বৃক্ষের ফুল-ফল এবং লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
  • বৃক্ষ সকল প্রাণিকুলের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে আর দেয় জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। ফলে প্রাণীরা এ জগতে বেঁচে থাকতে পারে।
  • আমরা তাপ উৎপাদন, রন্ধন এবং অন্যান্য জ্বালানি কাঠ বৃক্ষ হতে পেয়ে থাকি।
  • আসবাবপত্র, গৃহ, নৌকা, জাহাজ, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণে বৃক্ষ আমাদের কাঠ দেয়।
  • বৃক্ষ থেকে কাগজের মন্ড এবং রেয়ন শিল্পের কাঁচামাল ও দিয়াশলাই তৈরি হয়।
  • বনভূমি থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়।
  • গাছপালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।
  • গাছপালা জমির উর্বরতা-শাক্তি বৃদ্ধি করে অধিক উৎপাদনে সাহায্য করে।
  • গাছপালা নদীর ভাঙন, বৃষ্টিপাত ও পানি-স্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। এতে মাটিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
  • বৃক্ষাদি ঝড়-ঝঞ্ঝা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাসগৃহকে রাক্ষা করে।
  • বৃক্ষ আমাদের জীবন রক্ষার নানা ওষুধ দান করে।


বৃক্ষরোপণ অভিযান: বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা ও এর সম্প্রসারণের জন্যে আমাদের দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে। এ সময় পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। সাধারণত প্রতি বছর বর্ষাকালে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়। এ সময় জনগণ নিকটস্থ নার্সারী থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে। অভিযান চলাকালে আমাদের জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। নিঃসন্দেহে বৃক্ষরোপণ অভিযান একটি মহৎ প্রচেষ্টা।

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও গৃহীত পদপে: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮২ সালে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত ‘কমিউনিটি বনায়ন’ কর্মসূচি। ৭ হাজার গ্রামকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশের ৬১ জেলায় ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয় এবং বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে ৮০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আর জনসাধারণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা হয়। উপকূলীয় চরাঞ্চলে, সব কটি মহাসড়কের দুপাশে, রেল সড়কের ধারে এবং বাঁধ এলাকায় এই বনায়নে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। ১৯৯৬ সালে উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলের ম্যনগ্রোভ গাছপালা লাগানো শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সরকার বনায়ন বৃদ্ধিতে এখনো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।

বনায়নের উপায় : বাংলাদেশে বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। নানাভাবে এ বনায়ন সম্ভব। একটি পন্থা হলো : সামাজিক বন উন্নয়ন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো : রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করানো। জনগণ যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সেজন্যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা থাকতে হবে। তাছাড়া নানা জাতের বৃক্ষ মিশ্রণ করে রোপণ করতে হবে যেন গ্রামবাসীরা খাদ্য, ফল, জ্বালানী ইত্যাদি আহরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আর একটি বিকল্প হচ্ছে, বনায়ন কর্মীদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস প্রদান করা। এছাড়া সরাসরি ঋণ, ভর্তুকি এবং অনুদান প্রদান, বিনামূল্যে বীজ ও চারা সরবরাহ, বনায়ন-বৃক্ষায়ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, সার, খাদ্য ইত্যাদি সাহায্য, ফসল ভাগাভাগিকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করা। ওয়ার্ড মেম্বারের নেতৃত্বে এবং শিক্ষক, সমাজকর্মী, মসজিদের ইমাম প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম সংস্থা এই বনায়নের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে। এ সংস্থা সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সাথে সামাজিক বনায়ন-বৃক্ষায়ণ সম্পর্কিত সকল বিষয় তদারক করবে এবং গ্রামের জনসাধারণকে পরিবার ভিত্তিতে বনায়নের কাজে সম্পৃক্ত করবে। যেমন- বাঁধ, সড়ক, রেলপথ, খালের পাড়, খাস পুকুর পাড়, খাস জমি ইত্যাদির আশেপাশে যেসব পরিবার বাস করে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ পাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তার আওতায় তারা বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করবে এবং এ থেকে যে আয় হবে নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী সে আয়ের অংশ তারা পাবে। এভাবে যেসব পরিবার খালি জায়গা পাহাড়-পর্বতের আশেপাশে থাকে তাদেরকে সেখানে বনায়নে সম্পৃক্ত করা হবে।

বৃক্ষহীনতার অপকারিতা: বৃক্ষশূন্যতা যে কী ভয়াবহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফ্রিকার অঞ্চল। বৃক্ষশূন্য, পানিশূন্য এলাকার মানুষ চলে গেছে অন্য এলাকায়। বাংলাদেশেও এর অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো লেগেই আছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গীনহাউজ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বপরিবেশ আজ বিপর্যস্ত ও হুমকির সম্মুখীন।

উপসংহার: অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেবল বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে সরকারিভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনসেবা করলেই দেশ সবুজ হয়ে যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ কর্মসূচি পালন করে আসা হচ্ছে। অথচ বৃক্ষরোপণ অভিযান এখনো আশানুরূপ নয়। একে সফল করতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এমনকি স্কুল-কলেজে পাঠ্য পুস্তকে এর গুরুত্ব নির্দেশ করে আরো অধিক হারে প্রবন্ধ রচনা করা প্রয়োজন।

2 Responses to "বৃক্ষরোপণ বাংলা রচনা "